সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৯:০২ অপরাহ্ন

পল্লবীতে ছেলের সামনে বাবাকে হত্যা : সাবেক এমপি আউয়াল গ্রেপ্তার

পল্লবীতে ছেলের সামনে বাবাকে হত্যা : সাবেক এমপি আউয়াল গ্রেপ্তার

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানীর পল্লবীতে সন্তানের সামনে বাবাকে কুপিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। একই তথ্য দিয়েছেন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি মো. ইমরান।

ইমরান জানান, র‍্যাবের অভিযানে ভৈরব থেকে রাজধানীর পল্লবীতে সন্তানের সামনে বাবাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডের মূলপরিকল্পনাকারী ও হত্যা মামলার মূল আসামি মো. আউয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারওয়ান বাজারের র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে।

গত রোববার বিকেলে পল্লবীর ১২ নম্বর ডি ব্লক ৩১ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে ঘটনাটি ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম শাহিন উদ্দিন (৩৪)। তিনি পল্লবীর ১২ নম্বর সিরামিক রোডের বাসিন্দা।

পল্লবীর সেকশন-১২ উত্তর কালশীর সিরামিক ২ নম্বর গেটের সামনে শাহিন উদ্দিনের ওপর ফিল্মিস্টাইলে হামলা হয়। তার মুখে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়ার পর শুরু হয় চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপ। এ হামলাকাণ্ডে থানায় মামলা করা হয়। কিন্তু এর পরও প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় মামলার প্রধান আসামি মোহাম্মদ সুমন বাহিনীর প্রধান সুমন ও তার সহযোগীদের। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক সুমন বর্তমানে স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওই মামলায় কিছু দিন আগে আদালত থেকে ওয়ারেন্ট বের হয় তার নামে। ওই ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করে।

কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। কারণ গ্রেপ্তারের একদিন পরই জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন সুমন। ফলে মামলার তোয়াক্কা না করে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। সুমনের নেতৃত্বে চলা সন্ত্রাসী গ্রুপের কিলিং মিশনে গত রোবিবার বিকালে নৃশংসভাবে খুন হন শাহিন উদ্দিন। পল্লবীর ১২ নম্বর ডি-ব্লকে ৩১ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে সাত বছরের ছেলের সামনেই চাপাতি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।

নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, পল্লবীর সেকশন-১২ বুড়িরটেকস্থ আলীনগর আবাসিক এলাকার হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেডের এমডি এবং লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সাংসদ (এমপি) এমএ আউয়ালের সঙ্গে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ভাড়া করা স্থানীয় চারটি সন্ত্রাসী গ্রুপ একজোট হয়ে শাহিন উদ্দিনের ওপর হামলা চালায়। গ্রুপগুলো হলো- পল্লবী সেকশন-১২ ডুইপনগরের দিপু গ্রুপ, সিরামিকস এলাকার রাজন গ্রুপ, টেকেরবাড়ির আবুল গ্রুপ ও মাদকের ডিলার ইয়াবা বাবুর গ্রুপ। পল্লবীর উত্তর কালশীর বুড়িরটেকস্থ আলীনগর এলাকায় নিহত সাহিনুদ্দিনদের আনুমানিক ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০ একর জমি জবরদখলে বাধা দেওয়ায় খুন হতে হয় তাকে।

নিহতের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে গত সোমবার পল্লবী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় খুনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে প্রধান আসামি করা হয় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি লায়ন এমএ আউয়ালকে। অন্যদের মধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমন ছাড়াও মো. আবু তাহের, মুরাদ, মানিক, মনির, শফিক, টিটু, কামরুল, কিবরিয়া, দিপু, আবদুর রাজ্জাক, মরন আলী, লিটন, আবুল, বাইট্যা বাবু, বড় শফিক, কালু ওরফে কালা বাবু, নাটা সুমন, ইয়াবা বাবুকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই পল্লবী থানা এলাকার বাসিন্দা। এজাহারভুক্ত এ ২০ জন ছাড়াও অচেনা আরও ১৫ জনকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।

এজাহারে আকলিমা বেগম উল্লেখ করেন, পল্লবীর সেকশন-১২ আলীনগর বুড়িরটেক এলাকায় সপরিবারে বসবাস করেন তিনি। আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পল্লবীর উত্তর কালশীর বুড়িরটেকস্থ আলীনগর এলাকায় তাদের প্রায় ১০ একর জমি জবরদখলের পাঁয়তারা করছে। এ বিষয়ে বাদীর স্বামী জৈনুদ্দিন বাদী হয়ে ঢাকার ১ম সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা (ঢাকা দেওয়ানি মামলা নং-১১৮/১৫) করেন। পরবর্তী সময় আসামিরা তার ছেলে মো. সাহিনুদ্দিন ও মো. মাইনুদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করার বিষয়ে গত বছরের ২৬ নভেম্বর আকলিমা বেগম বাদী হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানার মামলা করেন। সাবেক এমপি আউয়াল ও আসামি আবু তাহেরের পরামর্শে ও প্ররোচনায় গত রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাহিনুদ্দিনকে ফোন করে বিরোধের বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য তাদের সঙ্গে দেখা করতে বলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুমন ও টিটু। সাহিনুদ্দিন তাদের কথামতো বিকাল ৪টার দিকে ৬ বছর বয়সী সন্তান মাশরাফিকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে পল্লবী থানাধীন সেকশন-১২, ব্লক-ডি, রোড-৩১, বাড়ি ৪০-এর সামনে আসতেই সুমন ও টিটুসহ অচেনা ১৪-১৫ যুবক শাহিন উদ্দিনকে প্রকাশ্যে টানাহেঁচড়া করে পার্শ্ববর্তী একটি গ্যারেজে নিয়ে ঢোকান। এ সময় তারা শিশু মাশরাফিকে বাইরে বের করে দিয়ে গেট আটকে রামদা, চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে এলোপাতাড়ি কোপায়। এতে তার মাথায়, বুকে, পেটে, ঘাড়ে, কানে, দুই হাতের কব্জি ও দুই পায়ের গিঁট ও হাঁটুতে গুরুতর জখম হয়। সাহিনুদ্দিনের মৃত্যু নিশ্চিত করার পর খুনিরা তার লাশ টেনেহিঁচড়ে গ্যারেজ থেকে বের করে ৩১ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে ফেলে বীরদর্পে চলে যায়। ছোট্ট মাশরাফি বাবার এ অবস্থা দেখে ভয়ে দৌড়ে বাসায় চলে যায় এবং পরিবারের সদস্যদের ঘটনাটি জানায়।

শুধু শাহিন হত্যাকাণ্ডই নয়, সাবেক সাংসদ এমএ আউয়ালের বিরুদ্ধে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে একরের পর একর সরকারি এমনকি ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তিও জবরদখলের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, মিরপুরের আলীনগর এলাকায় জমিজমার দখলবাজি বজায় রাখতে তিনি সেখানে গড়ে তুলেছেন প্রায় ৩০ সদস্যের একটি সশস্ত্র বাহিনী। কিছু দিন পর পর তার লালিত বাহিনীর সদস্যদের নামে মামলা হলেও সব সময় অধরা থেকে যান তিনি। তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এমএ আউয়ালের বাহিনী প্রায়ই জমিজমার দখলদারিত্ব নিয়ে কাউকে না কাউকে কুপিয়ে জখম করে। অভিযোগ, কিছু দিন আগেই সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার জমি দখল করার চেষ্টা করে তার বাহিনী। একপর্যায়ে লোক মারফত বড় অঙ্কের চাঁদা চাওয়া হয় তার কাছে। সেই চাঁদা দিয়েও রেহাই মেলেনি মেজর পদমর্যাদার সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তার। জোর করে তার জমিতে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় আউয়ালের বাহিনী। এ বিষয়ে গত ৭ মে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন মেজর (অব) মোস্তফা কামাল।

এদিকে পল্লবীতে মাদক কারবার ও জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মের সাম্রাজ্য ধরে রাখতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমনও গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে বা তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে তার আর রেহাই নেই- প্রকাশ্যে কোপানো হয়। এ নিয়ে গত কয়েক মাসের মধ্যে পল্লবী থানায় সুমন ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা এবং সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, সুমন বাহিনীতে আছে নারী সদস্যও। নারীদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা নেওয়া হয়। সুমন ছাড়া বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে আপন আহমেদ ওরফে আপন, সিফাত, রনি, জামান আহমেদ জামাল, লিজা, রাজন, সাগর, দুলাল, টিটু, দিপু, কাল্লু, লিটন, আবুল, বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু, রুবেল, জাকির, তাহের, হাবিব প্রমুখ। গত বছরের ৪ নভেম্বর সুমনসহ তার বাহিনীর নয় সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন শান্তা আক্তার নামে এক তরুণী। তিনি জানান, গত ২২ অক্টোবর বাবার সঙ্গে রাগ করে উত্তর কালশী ঘাটিপাড়া বস্তিতে বাসা ভাড়া নেন তিনি। ওই বাসাটি সুমনের সহযোগী আপনের। সেখানে ইয়াবা গোনার সময় শান্তা লিজা ও রনিকে দেখে ফেলেন। পরে তারা তাকে ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। এতে রাজি না হওয়ায় আপন তাকে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখায় এবং হুমকি দেয়।

শান্তা ভয়ে ওই বাসা ছেড়ে ৩০ অক্টোবর কালাপানি ডুইপ প্লট এলাকায় বাবার বাসায় চলে আসেন। ওইদিন বিকালে লিজা কৌশলে ফের তাকে আপনের বাসায় নিয়ে যায়। রুমে রেখে খাবার আনার কথা বলে পরিকল্পিতভাবে বের হয়ে যায় লিজা। এ সুযোগে সুমন, আপন, সিফাত ও রনিসহ কয়েকজন ওই রুমে ঢুকে দা দিয়ে শান্তাকে এলোপাতাড়ি কোপায়। এতে তার ডান হাতের কবজি গুরুতর জখম হয়। ডান হাতের দুটি আঙুল কেটে পড়ে যায়। হাতের তিনটি রগ কেটে যায়। বাম পায়ে নয়টি কোপ লাগে। একপর্যায়ে তার মৃৃত্যু হয়েছে ভেবে চলে যায় তারা।

গত ২৮ অক্টোবর সুমনকে প্রধান আসামি করে তার বাহিনীর ৬ জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা করেন মো. বাবু। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ নেতা সুমন ও তার বাহিনীর সদস্যরা বস্তিতে মাদক ব্যবসা এবং জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মে জড়িত। জুয়া খেলায় বাধা দেওয়ায় গত ২৬ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টায় আমি পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশন সিরামিক রোডের চান্দার টেক এলাকায় তার ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত জখম করে সুমন, জামাল ও রুবেলসহ আরও কয়েক সন্ত্রাসী। এ ছাড়া আরও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এ বাহিনীর বিরুদ্ধে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877